বক্সারের যুদ্ধ

বক্সারের যুদ্ধের কারণ

পলাশীর যুদ্ধের পর ‘কিং মেকার’ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মিরজাফরকে সিংহাসনে বসিয়ে তারা বাংলায় বিনাশুল্কে বানিজ্যের অবাধ অধিকার ও চব্বিশ পরগণার জমিদারি লাভ করে। কিন্তু ক্লাইভের উদ্ধত আচরণ, নবাবের প্রতি অসম্মান, ক্রমাগত অর্থশোষণ প্রভৃতি কারণে মিরজাফর ওলন্দাজ ও আর্মেনীয়দের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। খবর পেয়ে ক্লাইভ বিদারার যুদ্ধে ওলন্দাজদের পরাজিত করন এবং ওলন্দাজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে মিরজাফরকে পদচ্যুত করে তাঁর জামাতা মিরকাশিমকে বাংলার নবাব পদে বসায় ( ১৭৬০ খ্রিঃ ) । মিরকাশিম ছিলেন বিচক্ষণ , দূরদর্শী ও আত্মসচেতন । তাই ইংরেজের সাথে মিত্ৰতা করে মসনদ লাভ করলেও নবাবির মর্যাদাকে বিকিয়ে দিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে তাঁর সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং এই বিরোধের কারণগুলি হল----

  • রাজধানী স্থানান্তর: ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি মুরশিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে (বিহারে) রাজধানী স্থানান্তর করেন।
  • আর্থিক পদক্ষেপ: একজন স্বাধীন নবাবের মতােই মিরকাশিম আর্থিক সংস্কারের দ্বারা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। তিনি—
    • জমিদারদের ওপর কয়েকটি বাড়তি কর চাপান ও ভূমিরাজস্বের হার দেড় আনা বাড়ান।
    • ইংরেজদের প্রতি অনুগত রয়েছেন—এমন কর্মচারী ও জমিদারদেরও তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ইংরেজ মদতপুষ্ট বিহারের নায়েব দেওয়ান নবাবের প্রাপ্য অর্থ পরিশােধ ও হিসাবপত্র দাখিলের আদেশ অগ্রাহ্য করলে তিনি রামনারায়ণকে হত্যা করেন।
    • রাজস্ব আত্মসাৎকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ও কঠোর শাস্তি দেন।
    • আলিবর্দি ও মিরজাফরের পরিবারবর্গের কাছ থেকে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ জোর করে আদায় করেন।
  • সামরিক উদ্যোগ:অতীতের যুদ্ধগুলি থেকে তিনি বুঝেছিলেন যে , প্রাচীন যুদ্ধকৌশলই ভারতীয় বাহিনীর প্রধান দুর্বলতা । তাই সামরিক বাহিনীর আমূল সংস্কার সাধনের জন্য এবং নবাব বাহিনীকে ইউরােপীয় আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষিত করার জন্য তিনি মার্কার , সামরু ও জেন্টিল নামক তিনজন ইউরােপীয় সেনাপতি নিয়ােগ করেন । কিছু সংখ্যক আর্মেনিয়ানকেও তিনি সৈনিক হিসেবে নিযুক্ত করেন । উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের শক্তিশালী , পরিশ্রমী ও দুর্ধর্ষ তাতার , আফগান ও পারসিকদের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করেন । এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির জন্য তিনি মুঙ্গেরে একটি অস্ত্র নির্মাণ কারখানা করেন ।
  • শুল্ক বিবাদ: ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দের ফরমান অনুযায়ী কোম্পানি রপ্তানি বাণিজ্যে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা ভােগ করত । কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তীকালে কোম্পানির কর্মচারীরাও তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যেও শুল্ক ছাড়ের সুবিধা ভােগ করতে শুরু করে । পরিণামে দেশীয় বণিকগােষ্ঠীর বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নবাবও তাঁর প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হন। মিরকাশিম এই সংকটমােচনের জন্য ভ্যান্সিটার্ট-এর কাছে এক আবেদন জানান। কিন্তু তাতেও সংকটের নিরসন না হওয়ায় মিরকাশিম দেশীয় বণিকদের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেন। ফলে কোম্পানিকে দেশীয় বণিকদের সঙ্গে প্রতিযােগিতামূলক বাণিজ্যের মুখােমুখি হতে হয়।

বক্সারের যুদ্ধ

  • উপরোক্ত কারনে ইংরেজদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ও তারা মিরকাশিমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়। ফলে ইংরেজ ও কোম্পানি, উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
  • কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুটি, মুঙ্গের ও উদয়নালার যুদ্ধে মিরকাশিম ইংরেজের হাতে পরাজিত হন । ইংরেজ বাহিনী মুঙ্গের দখল করে নিলে মিরকাশিম অযােধ্যায় পালিয়ে যান ।
  • এই অবস্থায় ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মিরকাশিমকে সিংহাসনচ্যুত করে ইংরেজরা মিরজাফরকে আবার বাংলার মসনদে বসান । কিন্তু মিরকাশিম হাল না ছেড়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং দিল্লির নামমাত্র সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম -এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পুনরায় বাংলায় প্রবেশ করেন ।
  • বক্সারের প্রান্তরে উভয়পক্ষের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । কিন্তু মিরকাশিম , সুজা ও শাহ আলমের মিলিত বাহিনী ইংরেজের কাছে পরাজিত হয় ( 1764 খ্রিস্টাব্দে 22 অক্টোবর )।

বক্সারে যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব

  • সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি সুদৃঢ়: পলাশির যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছিল। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনকে দঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।
  • বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়: বক্সারের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীনচেতা নবাব মিরকাশিমের পরাজয় ঘটায় ব্রিটিশ শক্তিকে বাধা দেওয়ার মতাে আর কোনাে শাসক রইল না, ফলে বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ নিস্কণ্টক হল।
  • উত্তর ভারতে আধিপত্য সূচনায়: পলাশির যুদ্ধে শুধু বাংলার নবাব পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু বক্সারের বাংলার নবাবের সাথে অযোধ্যার নবাব ও দিল্লির বাদশাহও পরাজিত হন। ফলে সমগ্র উত্তর ভারতে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • আর্থিক লুণ্ঠনের সূচনায়: বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় কোম্পানির অবাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠন শুরু হয়। কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমলারা নতুন নবাব নজম-উদদৌলার কাছ থেকে পনেরাে লক্ষ টাকা উপঢৌকন হিসেবে আদায় করে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ অযােধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলার কাছ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়।
  • দেওয়ানি লাভ:বক্সারের যুদ্ধে চরম প্রাপ্তি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশায় দেওয়ানি লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের ফলে একদিকে বাংলার রাজনীতিতে কোম্পানির কর্তৃত্ব দৃঢ় হয়েছিল অপরদিকে কোম্পানির আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বহুগুণ বেড়েছিল।